জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি অনুসমর্থন করুক বাংলাদেশ!
আবু রায়হান মু. খালিদ[1]
গত ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ আইভরি কোস্ট ৩৪তম দেশ হিসাবে
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি অনুসমর্থন করেছে| জাতিসংঘের এই চুক্তিটির
আনুষ্ঠানিক নাম ‘আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ্সমূহের অনাব্য ব্যবহারের আইন সংক্রান্ত
জাতিসংঘ চুক্তি, ১৯৯৭’ বা ‘ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য ল অফ দ্য নন-নেভিগেশনাল
ইউজেস অফ ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস, ১৯৯৭’| কনভেনশনের ৩৬(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ৩৬তম অনুসমর্থন বা রেটিফিকেশন, অনুমোদন,
যোগদানকরণ দলিল জমা পড়ার নব্বুইতম দিবসে এই কনভেনশন কার্যকর হবে| তার মানে আর একটি
উপরোক্ত দলিল জমা পড়লেই তার নব্বুইতম দিবসে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি
কার্যকর হবে| বাংলাদেশ এখনো এই কনভেনশনটি অনুসমর্থন করেনি, বাংলাদেশ কি হতে পারে
সেই ৩৬তম দেশ যে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ কনভেনশনটিকে কার্যকর করবে?
৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে
বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে| এর মধ্যে ৩ টি নদী এসেছে মিয়ানমার থেকে আর বাদবাকি ৫৪ টি
নদী এসেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে| এর মানে হচ্ছে জাতিসংঘের এই চুক্তিটি
বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ন, কেননা বাংলাদেশ বদ্বীপ গঠিত হয়েছে এই
আন্তর্জাতিক নদীগুলোর বয়ে আনা পলিমাটি দ্বারা, এবং বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর অর্থনীতি
টিকেও আছে এই আন্তর্জাতিক নদীগুলোর বয়ে আনা পানির ওপর নির্ভর করে| নদীর পানি
ব্যতীত নদীমাতৃক বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যত কল্পনা করা যায়না|
আন্তর্জাতিক নদী হচ্ছে সেই নদী যেটি একের অধিক দেশের
ভুখন্ডের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে| ফলে আন্তর্জাতিক নদীর পানিতে একাধিক দেশের
মালিকানা ও দাবি থাকে| যেহেতু বিশ্বজুড়ে পানি ক্রমশই দুর্লভ হয়ে উঠছে, পানির বন্টন
সংক্রান্ত বিরোধের সংখ্যা ও তীব্রতাও ক্রমশ বাড়ছে| জাতিসংঘের প্রাক্তন মহাসচিব
বুট্রোস বুট্রোস ঘালি বলেছিলেন পরবর্তী বিশ্বযুদ্ধ তেল বা দেশের সীমানা নিয়ে
হবেনা, হবে পানি নিয়ে| মিঠাপানির প্রাপ্যতা নিয়ে অংশীদার দেশগুলো এতই স্পর্শকাতর
থাকে যে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি বা ঐক্যমতে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়: সিন্ধু
নদের পানি চুক্তিতে পৌঁছতে লেগেছে প্রায় দশ বছর, আর আমাদের বর্তমান গঙ্গা বা পদ্মা
চুক্তিতে পৌঁছতে সময় লেগেছে প্রায় ৩০ বছর! প্যাসিফিক ইনস্টিটিউট ফর স্টাডিজ ইন
ডেভেলপমেন্ট, এনভায়রনমেন্ট এন্ড্ সিকিউরিটি এর হিসাব মতে গত ৫০ বছরে পানি
সম্পদ নিয়ে ৫০৭ টি বিরোধের সূত্রপাত
হয়েছে, যার মধ্যে ৩৭টিতে শক্তিপ্রয়োগের ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে|
১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের উপরোক্ত চুক্তিটি আন্তর্জাতিক
মিঠাপানি সংক্রান্ত একমাত্র বিশ্বজনীন চুক্তি| ১৯৭০ সালে জাতিসংঘ এ চুক্তির জন্য
আলাপ আলোচনা শুরু করে এবং দীর্ঘ ২০ বছর ধরে আলোচনার পর জাতিসংঘ বর্তমান চুক্তিতে উপনীত
হয়| প্রাথমিকভাবে ১৬ টি দেশ চুক্তিটি সই করে এবং চুক্তি অনুসমর্থনের জন্য উন্মুক্ত
করে দেয়া হয়| গত ২০১৩ সালের ১৩ই ডিসেম্বর তারিখে যুক্তরাজ্য ও ২০ ডিসেম্বর তারিখে
আয়ার্ল্যান্ড কনভেনশনটি অনুমোদন করে এবং এর মাধ্যমে এই চুক্তি একটি মজবুত ভিত্তিতে
অধিষ্ঠিত হয়| আর গত ২৫শে ফেব্রুয়ারী ২০১৪ তারিখে আইভরি কোস্টের অনুসমর্থনের
মাধ্যমে জাতিসংঘের ১৯৯৭ সনের আন্তর্জাতিক পানি চুক্তি একটি যুগান্তকারী ঘটনার
দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছে, আর মাত্র একটি অনুসমর্থন বা অনুমোদনের মাধ্যমে এই
বহু প্রতিক্ষিত কনভেনশনটি কার্যকর হতে পারে আর দিতে পারে পানি বঞ্চিত দুর্বল
রাষ্ট্র সমূহকে একটি আশ্রয়ের স্থল|
এখানে উল্লেখযোগ্য যে উপমহাদেশের বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান
নেপাল ভুটান কেউই এই কনভেনশনটি অনুসমর্থন করেনি| এই কনভেনশনের এমন কিছু বিধান আছে
যা শক্তিশালী উজান দেশের বিপক্ষে যায়| যেমন ১৯৯৭ সনের জাতিসংঘ কনভেনশনের ৩৩(২)
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে পক্ষগণের মধ্যকার বিবাদের ক্ষেত্রে উভয় পক্ষ যদি সম্মতিতে
পৌঁছতে ব্যর্থ হয় তবে তারা কোনো তৃতীয় পক্ষকে তাদের মধ্যে মিমাংসা করে দেয়ার জন্য
আহবান জানাতে পারবে| এই পরিস্থিতি দেখা যায় বিশেষ করে যখন বিবাদটি হয় দুটি অসম
শক্তির দেশের মধ্যে, এসব ক্ষেত্রে প্রবল শক্তির দেশ দুর্বল শক্তির দেশের উপর তার
ইচ্ছা বা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় নানান ছলা কলা ব্যবহার করে, সামরিক ও
অর্থনৈতিক শক্তির ব্যবহারও দেখা যায় কখনো কখনো| আর তার ফলে পানি বন্টনের যে
আলোচনা, তা আর ন্যায্য থাকেনা, দুর্বল দেশটির জনগণ তাদের যৌক্তিক ও ন্যায্য পানির
অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়| এ সকল ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী তৃতীয় পক্ষের অন্তুর্ভুক্তি
দুর্বল দেশটিকে এই অন্যায্য উত্পীড়ন থেকে রক্ষা করতে পারে| কখনো কখনো সমশক্তির
পক্ষগণের মধ্যেও আলোচনায় অচলবস্থা দেখা দিতে পারে| উদহারণ স্বরূপ বলা যায় আমাদের
প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্থানের মধ্যে যখন সিন্ধু নদের পানির বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু
হয় তখন এরকম একটি অচলবস্থার সৃষ্টি হয়, তখন বিশ্বব্যাংক সেখানে তৃতীয় পক্ষের
ভূমিকা পালন করে এবং বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০
সালে সিন্ধু পানি চুক্তি সম্পাদিত হয়| দুঃখজনক ভাবে বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতের
মধ্যে পানি বন্টনের আলোচনায় বাংলাদেশের বারংবার দাবি করা সত্তেও কোনো তৃতীয় পক্ষকে
অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি মূলত ভারতের বিরোধিতার কারণে| শক্তিশালী উজানের দেশ ভারত এই
আলোচনা সকল সময় দ্বিপাক্ষিক রাখতে বদ্ধপরিকর ছিল| আর এর ফল বাংলাদেশের জন্য কখনো
ভালো হয়নি| বাংলাদেশ কখনই ভারতের কাছ থেকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা বুঝে পায়নি|
ফারাক্কা থেকে তিস্তা আর টিপাইমুখ, কোথাও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি|
একটি অতি-পানিনির্ভর দুর্বল রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের
অতিসত্বর এই কনভেনশনটি অনুসমর্থন করে একে কার্যকর করতে উদ্যোগ নেই উচিত, বাংলাদেশ
এতবছর কেন এই উদ্যোগ নেয়নি সেটি রহস্যাবৃত| আইনের সুরক্ষা তো তারই প্রয়োজন যার
বাহুবল নেই|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন