বাংলাদেশের লেখকরা নিরাপদ নন সত্য, আমেরিকার লেখকরা কি নিরাপদ?
স্টিফেন কিংয়ের, (উইকিপিডিয়া) প্রায় আত্মজীবনীমূলক অন রাইটিং ( On Writing: A Memoir of the Craft) বইটির অডিও বুক সংস্করণ শোনা সমাপ্ত হলো দুদিন আগে। তিনি তাঁর সারা জীবনের লেখক হয়ে ওঠার গল্প শোনালেন নিজ জবানিতে। যারা লেখক হতে ছান, বিশেষ করে উপন্যাস বা গল্প লেখক, এতে তাঁর জন্য বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকদের একজনের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শ রয়েছে।
শেষ অংশে যোগ করলেন এক বিশেষ বিবরণ। তিনি যখন লেখার কৌশলের ওপর এই বই লেখার প্রস্তাব করলেন তার প্রকাশককে, এবং লেখা যখন অনেকটা এগিয়েছে তখন একদিন, ১৯৯৯ সালে, তিনি নৈমত্তিক শরীর চর্চার উদ্দেশ্যে হাঁটতে বের হলেন রাস্তায়। পথে একটি ভ্যান গাড়ি তাকে চাপা দিলো (খবর দেখুনঃ Author Stephen King Hit by Van, SeriouslyHurt)। তাঁর পা হাঁটু বহু টুকরায় ভেঙে চুরমার হলো, বহু চিকিৎসায় তা জোড়া দেয়া গেল, তিনি প্রাণে বাঁচলেন প্রায় অলৌকিক ভাবে। তিনি বিস্তারিত ভাবে তার বর্ণনা করলেন; উল্লেখ করলেন বিপদে পড়লে সবাই নাম ধরে ডাকে।
স্টিফেন কিং বিশ্ব বিখ্যাত উপন্যাস লেখক, ইংরেজি ভাষায় সর্বাধিক বিক্রীত বইগুলোর মধ্যে তার বই, সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকদের একজন। তিনি বর্ণনা করলেন যে ড্রাইভার তাকে চাপা দিলো, এবং তারপর যারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল এদের সবার মধ্যে তিনি এক শান্ত নির্বিকার মনোভাব লক্ষ্য করেছেন।
আমার তৎক্ষণাৎ আমার নিজের পরিস্থিতির কথা মনে পড়লো। যারা আমাকে এই এতদিন ধরে নির্যাতন করছে, যারা পোস্ট অফিসে কোর্টে হাসপাতালে আমাকে অপমান করছে, তাদের কারো মধ্যে বিকারের কোনো লক্ষণ নেই। সবাই শান্ত, এমনকি দৃশ্যমান ভাবে কিছুটা হাসিমুখ। যেন বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিজেদের আয়োজনের নাটকে অভিনয় করছেন। তারা যে আমাকে তিলতিল করে ধ্বংস এবং হত্যার বৃহৎ পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ করছেন, এই কাজে যার যার ক্ষুদ্র ভূমিকা পালন করছেন, তার চিহ্ন মাত্র তাদের মুখায়বে, ভাবে নেই।
যেন আমাকে গত ৩৮ বছর ধরে নজর বন্দি করে রাখা হয়নি; যেন ২০০৩ সালের ১৫ই নভেম্বর তারিখ থেকে আমার মস্তিস্ক উন্মুক্ত করে দেয়া হয়নি; যেন আমার পারিবারিক ও ব্যাক্তিগত সমস্ত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করা হয়নি; যেন এই দলের প্রযোজনায় আমার বড় ভাইকে বধির করে দেয়া হয়নি, তাঁকে তাঁর কর্মজীবন, পারিবারিক জীবন, সন্তান লাভ থেকে বঞ্ছিত করা হয়নি; যেন আমার পিতার শেষ দিন গুলোতে আমাদের বাড়ীতে বিবাদের সৃষ্টি করে তাঁকে সহ আমাদের সব ভাইদেরকে হত্যা চেষ্টা করা হয়নি; যেন আমার দুই সন্তানের রক্তপাত হয়নি, যেন আমার দ্বিতীয় সন্তানের সেই মাথায় আঘাতের ফলে তাঁর চোখে ও দৃষ্টিতে স্থায়ী ক্ষতি হয়নি, তাঁর বাচন ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি; যেন আমার মেঝ ভাইয়ের একমাত্র ছেলেকে এদের আয়জনে প্রতিবন্ধী করে দেয়া হয়নি; যেন আমাকে আমার পেশাজীবন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়নি; যেন আমার এত শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা থাকা সত্তেও আমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়া হয়নি; যেন আমার বড় মামা ও ছোটমামা এদের প্রযোজনায় অকালে মৃত্যু বরণ করেননি; যেন আমি গত দুই বছর যাবত স্ত্রীপুত্র বিহিন একাকী প্রায় কারা অন্তরিন হয়ে দিন কাটাচ্ছি না; যেন আমার পরিবারের সকল অংশ কোন না কোন ভাবে এদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; যেন এদের নির্যাতনে উচ্চ রক্তচাপ, স্নায়ুব্যাধি সহ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়ে যাইনি; যেন আমাকে হত্যার বহু চেষ্টা করা হয়নি, যেন করা হচ্ছেনা।
সে হাইকোর্টের সব-পোস্ট মাস্টার বা আমার প্রাক্তন প্রিয় কর্মক্ষেত্রের সহকর্মীরা, সেখনাকার অধিকারী, সবাই। এমনকি আমার আপন পরিবারের কেউ কেউ। আমার এসব ক্ষতির কথা বাইরের অনেকে হয়ত জানেনা, কিন্ত কম বেশী জানেন এমন লোকের সংখ্যাও তো ঢাকায় খুব কম নয়। যেন কোন এক মাদকের প্রভাবে এঁরা হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়েছেন এবং এক স্থায়ী ঘোরের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছেন। এদের মধ্যে যারা আমার এক সময়ের প্রিয় মানুষ ছিলেন, তাদের জন্য আমার বেদনা বোধও হয়; এই নির্বিকার মনোভাব সস্তায় আসেনা।
ফিরে আসি স্টিফেন কিঙের ঘটনায়। তারা সবাই তাঁর নাম ধরে তাকে ডাকলো, মোটের ওপর রূঢ় ব্যবহার করলো যা তার মনে স্থায়ী দাগ ফেললো। হাসপাতালে চিকিৎসার সময় তার যে যন্ত্রণা ভোগ হলো তার বর্ণনায় তিনি বললেন, 'আমার হাঁটু কখনো কেরোসিন তেলে চুবিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়নি, যদি হতো, তবে তার যন্ত্রণা এর অধিক হতো বলে মনে হয়না'। তিনি সুস্থ হলেন কয়েকমাস ধরে, পরে হুইলচেয়ারে বসে দারুন ব্যথা যন্ত্রণার মধ্যেই তাঁর বইয়ের বাকি অংশ সমাপ্ত করলেন। বইটি ২০০০ সালে প্রকাশিত হল; মনে পড়ে সেই বছরের অক্টোবর মাসে আমার ইংল্যান্ড যাত্রার দিন ভোর বেলা আগারগাঁও বিএনপি বস্তির সামনে আমি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ি, একই স্থানে ২০১৫ সালে আবার। ইঙ্গিত দিলেন অনেক কিছু তিনি তরুণ লেখকদের উদ্দেশ্যে বলবেন স্থির করেছিলেন তার কতকটা না বলা থেকে গেলো, কারণের মধ্যে যোগ হলো এই দুর্ঘটনা। বোঝা গেল তিনি টেলিভিশন দুচক্ষে দেখতে পারেননা, বললেন লেখক হওয়ার পথে এই এক বিরাট বাধা। বললেন, লেখককে লেখার কাজটা ভালবেসে করতে হবে, টাকার জন্য লিখলে ভাল লেখা হবেনা। লিখলে যদি আপনি সুখী বোধ করেন, তবে সেই সুখের জন্যই লিখুন, সাফল্য আপনি আসবে। আর যারা সাফল্যের জন্য সফল লেখার অনুকরণে লেখার চেষ্টা করেন, তাদের লেখা প্রাণহীন, কিছুটা একঘেয়ে হয়।
যে ড্রাইভার তাঁকে চাপা দিল সে কিছুদিন পর মারা যায়।
তিনি নাম করে অবশ্যই বলেননি, তবে তার লেখা পাঠে পাঠক বুঝতে পারেন তিনি বলছেন, তিনি উৎসাহী লেখকদের জন্য এই বই লিখতে শুরু করেছেন বলেই তার উপর এই প্রাণঘাতী হামলা হলো। তিনি বেঁচে গেলেন নিতান্ত দৈবাৎ। মনে পড়লো আমাদের হুমায়ন আজাদের কথা, লেখকরা বাংলাদেশ আমেরিকা সব দেশে কি একই ভাগ্য বরণ করেন? আমারো এই নির্যাতন ভাগ্য তীব্র হয়েছে যদ্দুর বুঝতে পারি আমার আশৈশব লেখার কারণে। আঠারো বৎসর বয়সে আমার লেখার শুরু, এখনো লিখে যাচ্ছি, অধিকাংশই প্রকাশিত হয়নি, কিছু কবিতা বাদে প্রায় সবাই অগল্প, প্রবন্ধ; বিষয় মূলত মানব কল্যাণ।
সম্প্রতি এমন ধারণা সমাজে প্রচারিত হচ্ছে যে বাংলাদেশকে লেখকদের জীবন নিরাপদ নয়। লেখক, ব্লগার, অধ্যাপকরা নিহত হচ্ছেন আততায়ীদের হাতে। এমনকি বিদেশ থেকে দেশে বেড়াতে এসে বইমেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র প্রাঙ্গনে আততায়ীর হাতে প্রাণ দিচ্ছেন। দেশে বিদেশে পত্রিকায় টেলিভিশনের খবরে সেমিনারে বক্ত্রিতায় এ নিয়ে বিদেশিরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। কোনো গুপ্ত রাজনৈতিক দল প্রতিবারই বিলম্ব না করে নিষ্ঠার সাথে সেই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব স্বীকার করছে।
রুটিন।
যে বিষয়টা স্পষ্ট করে দেয়া হচ্ছে তা হলো বাংলাদেশ লেখকদের জন্য নিরাপদ নয়।
দেশের মানুষ তার সাথে দেশের প্রধান দৈনিকে নিত্য বিদেশে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অভ্রভেদী সাফল্যের খবর পড়তে থাকে, সেই খবরে আবার প্রায়শঃ কোন শেতাঙ্গ ব্যক্তির পাশে হাস্যজ্জল ড্যাম কেয়ার বাংলাদেশি বিশ্বজয়ীর ছবি থাকে। তখন এই সিদ্ধান্ত নিতান্ত স্বাভাবিক যে এই দেশে মেধার বিকাশের স্থান নেই; তথাকথিত 'মূল্যায়ন নেই'। অতএব, বিদেশ চলো, সবচে ভালো হয় যদি আমেরিকা যেতে পারা যায়। সেখানে গিয়ে নির্ভাবনায় মনের যা কিছু ভাব, তা মুক্ত ভাবে প্রকাশ করবো। আমেরিকা স্বাধীনতার দেশ, মুক্ত দেশ। "ইটস এ ফ্রি কান্ট্রি", মার্কিন মিডিয়ার বহুল ব্যবহৃত সংলাপ মনে আসে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা দরকার মনে করছি আমার একজন মেধাবী বন্ধু ইউরোপের এক স্বর্গোপম নগরীতে নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী ছেড়ে দেশে ফিরে এসেছেন বেশ কিছুদিন হলো। তার কথায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তাঁকে বঞ্চিত করে এক স্থানীয়কে অগ্রাধিকার দেয়ায় তাঁর মনে হয়েছে এ শুধু তাঁর বাংলাদেশি অতীতের ফল। বোধ হয় এটি একমাত্র ব্যতিক্রম।
তার ওপর স্পষ্ঠ করেই একদিন একজন প্রবাসী বাংলাদেশি লেখক বা এ সংক্রান্ত ব্যক্তি টিভিতে বললেন শুনলাম, এদেশে পুস্তক প্রকাশ করে তাতে আর্থিক ভাবে লাভবান হবার সম্ভাবনা নেই, বাজার অনুপস্থিত। বিদেশে প্রকাশ করলে আর্থিক উন্নতির বিশেষ সম্ভাবনা।
কিন্তু স্টিফেন কিং ভিন্ন খবর দিলেন, আমেরিকার লেখকরাও একই বিপদের শিকার, উপরন্তু তাদের দেশের লেখকদের একটি বাড়তি বিপদ আছে, প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদকরা। বাংলাদেশেও তা উপস্থিত হলো বলে।
তবে মুক্ত হাওয়ার স্বাস নিতে, অবাধে মনের কথা লিখে প্রকাশ করে লেখক হতে দেশ ছেড়ে বিদেশ আমেরিকা গিয়ে বিশেষ সুবিধা সুযোগ দেখা যায়না। যেন ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়াই হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন